• Sunrise At: 6:37 AM
  • Sunset At: 5:18 PM
info@talimeislam.com +88 01975539999

মুসলিম নারীদের উদ্দেশে 

আল্লামা মুফতি তাকী উসমানী দাঃবা

হামদ ও ছানার পর

মুহতারাম বোনেরা আমার!

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ।

সর্বপ্রথম আমি আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি আপন ফযল ও করমে এখানে উপস্থিত হওয়ার তাওফীক দান করেছেন। অন্তরের অন্তস্তল থেকে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আপনারা যে মহব্বত ও আন্তরিকতার সাথে এ অধমকে বরণ করে নিয়েছেন, বাস্তবে সে এর উপযুক্ত নয়। আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে এর উত্তম জাযা দান করুন।

নারীগণ সমাজের মূল স্তম্ভ

আমাকে আদেশ করা হয়েছে- আপনাদের খেদমতে দ্বীনের কিছু কথা আরয করতে। দ্বীনের কথা বলতে সবসময় অত দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন পড়ে না। আল্লাহ তাআলা যদি ইখলাছের সাথে কিছু বলার ও শোনার তাওফীক দান করেন, তাহলে অল্প কথাতেও অনেক ফায়দা হয়। আর আল্লাহ হেফাযত করুন- ইখলাস যদি না থাকে, তাহলে লম্বা-চওড়া বয়ানও বেকার হয়ে যায়।

মূলত আমি নসীহত করার যোগ্য কেউ নই। তবে মুরুব্বীদের থেকে শুনেছি যে, আল্লাহ তাআলা নারী জাতিকে এ উম্মতের বিনির্মাণের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে নারীগণ হচ্ছেন একটি সমাজের মূল স্তম্ভ-ফাউন্ডেশন। তাদের উপর ভর করেই পুরো সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে এবং গোটা জাতি প্রতিপালিত হয়।

আমি তো বলি, আজ আমরা যেসব বড় বড় আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ, মুফতী-মুহাদ্দিস-মুফাসসির, ওলী-বুযুর্গের কথা শুনি, নাম শোনামাত্র তো তাদের কীর্তিগুলো মনে পড়ে যায়, কিন্তু পর্দার অন্তরালের ঐসব নারীদের কথা আমাদের খুব কমজনেরই মনে আসে, যাদের নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও কুরবানী, শ্রম ও মেহনত  এবং তালীম ও তরবিয়তের বদৌলতে আজ এঁরা এত বড় বড় ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে পেরেছেন।

ইমাম আবু হানীফা রাহ.-কে আজ কে না চেনে! ইমাম বুখারী রাহ.-কে কে না জানে!! কিন্তু ঐসব মা কেমন ছিলেন, যারা ইমাম আবু হানীফা, ইমাম বুখারী রাহ. প্রমুখের মত মহারত্নগুলোকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন! জন্মের পর সঠিক তরবিয়তে বড় করেছিলেন। যার ফলে তারা চাঁদ সুরুজের মত অন্ধকার দুনিয়ায় আলো বিকিরণ করেছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তাদের খিদমাত থেকে আলো পাবে ইনশাআল্লাহ।

এসব বুযুর্গানে দ্বীন যাদেরকে আজ আমরা চিনি, আল্লাহ তাআলার দরবারে তো তারা  (ইনশাআল্লাহ) অবশ্যই মকবুল ও মনোনীত হয়েছেন। কিন্তু পর্দার আড়ালে থেকে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাওয়া এসব মা-জননী যারা এ বুযুর্গদেরকে গর্ভে ধারণ করেছেন, বলুন আল্লাহর দরবারে তাদের মর্তবা কত উঁচু হতে পারে! ভাগ্যবতী এসব মায়ের নামধামের কোনো ফিকির ছিল না। ছিল না পদ-পদবীর কোনো লালসা। ব্যস, আল্লাহর দেওয়া আমানত-সন্তানের এমন তরবিয়ত তারা করে গেছেন, যার ফলে তাঁরা চাঁদ-সুরুজ হয়ে দুনিয়া আলোকিত করেছেন। এ বিবেচনায় চিন্তা করে দেখুন, আল্লাহ তাআলা মাতৃজাতিকে কত উচ্চ আসনে সমাসীন করেছেন!

মাতৃকোলকে রাব্বুল আলামীন সন্তানের সর্বপ্রথম বিদ্যালয় বানিয়েছেন। আমাদের ইতিহাসে এমন ঘটনা অনেক যে, মা-সন্তানের মুখে যখন দুধ দিবেন, তখন তার যবানে তিলাওয়াত জারি থাকত। সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত করে করে সন্তানকে দুধ পান করাতেন মায়েরা। বলুন, যে শিশুর প্রতিপালন ও তরবিয়ত এমন কোলে হয়, জাতির জন্য সে কত উজ্জ্বল আলো হতে পারে! আমার বলার উদ্দেশ্য হল, আপনারা আপনাদেরকে চিনতে ও বুঝতে চেষ্টা করুন।

সকল আমলের মূল  ‘তাআল্লুক মাআল্লাহ’

বোনেরা আমার! গোটা দ্বীনের মূল কথা হচ্ছে, আল্লাহর সাথে আল্লাহর বান্দা-বান্দীদের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাওয়া এবং তা মজবুত থেকে মজবুত হতে থাকা। আল্লাহর সাথে যদি বান্দার সুসম্পর্ক হয়ে যায়, সর্বাবস্থায় সে যদি আল্লাহমুখী হওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে দ্বীনের উপর চলা তার জন্য আসান হয়ে যায়। সমস্যা তখনই দেখা দেয়, যখন আমরা গাফলতে পড়ে যাই, আল্লাহকে ভুলে বসি, যখন আল্লাহর সাথে সম্পর্ক কমজোর হয়ে যায়। তখন গোনাহ হতে থাকে, আল্লাহর নাফরমানী হতে থাকে। উল্টা-পাল্টা হতে থাকে। ফরয-ওয়াজিব ছুটতে থাকে। কিন্তু যখন আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত থাকে, তখন দ্বীনদারি পালন করাও সহজ হয়।

শোকরের এহতেমাম : তাআল্লুক মাআল্লাহ তৈরির একটি মাধ্যম

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তরিকা বাতলে দিয়েছেন যে, কোন কোন আমল করলে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে এবং দ্বীনের উপর চলা আসান হয়ে থাকে। একটি সহজ আমল হচ্ছে শোকরের এহতেমাম। অর্থাৎ বেশি বেশি আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করা। আল্লাহ তাআলা যখন যে নিআমত দান করেন, ছোট হোক বা বড়, সাথে সাথে শোকর আদায় করা। কোনো বিষয় সামনে এসেছে, যাতে মনটা ভালো লাগছে, সাথে সাথে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করা। নিজের মর্জি মোতাবেক কোনো কাজ হাছিল হয়েছে, তো যথাসাধ্য শুকরিয়া আদায় করার চেষ্টা করা। বেশি বেশি শুকরিয়া  আদায়ে নিজেও অভ্যস্ত হওয়া এবং বাচ্চাদেরও সে অভ্যাসে গড়ে তোলা।

ইদানীং ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে যে, কোনো বাচ্চাকে যদি আদর করে জিজ্ঞাসা করা হয়, বাবু! কেমন আছো? ভালো আছো? তো তারা উত্তরে শুধু এতটুকু বলে, হাঁ, ভালো আছি। ব্যস, আর কিছু বলে না। তারা যদি সঠিক তরবিয়ত পেত তাহলে ‘হাঁ, ভালো আছি’ বলে ক্ষান্ত থাকত না। অবশ্যই বলত, ‘আলহামদু লিল্লাহ, ভালো আছি’্। এই কালিমাতুশ শুকর-‘আলহামদু লিল্লাহ’ তাদের মুখে মুখে জারি করার জন্য সঠিক তরবিয়তের প্রয়োজন। বাচ্চাদের যদি সর্বাবস্থায় শুকরিয়া আদায়ের তরবিয়তে গড়ে তোলা হয়, তখন তারা আলহামদু লিল্লাহ বলতে শিখবে। তবে এর জন্য নিজে আগে বেশি বেশি শুকরিয়া আদায়ে অভ্যস্ত হতে হবে।

রাতে শোবার সময় কিছুক্ষণ চিন্তা করুন, আজকের এ দিনে আল্লাহ তাআলা আপনাকে কত কত নিআমতে ভূষিত করেছেন! বেশি সময় নয়, অল্প সময় চিন্তা করুন। একেকটি নিআমত মনে করুন আর দিল থেকে বলুন- ‘আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু ওয়া লাকাশ শুক্র’।

اللهم لك الحمد ولك الشكر

হে আল্লাহ, আপনার খাছ মেহেরবানী, ঘরে সবাই সুস্থ ও নিরাপদ রয়েছে। কারো কোনো রোগ-বালাই নেই। হে আল্লাহ, আপনার শোকর, আপনি থাকার জন্য ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আপনার এহসান, শোবার জন্য বিছানার এন্তেযাম করে দিয়েছেন। আপনার ফযল ও করম, আপনি আমাকে সন্তান-সন্ততি দান করেছেন। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন দান করেছেন।

এভাবে আল্লাহর দেওয়া নিআমতের কথাগুলো স্মরণ করুন আর শুকরিয়া আদায় করুন। এটা অনেক বড় আমল। যদিও একে মামুলি মনে হয়, কিন্তু এর ফায়দা অনেক বেশি।

দুআর আধিক্য : তাআল্লুক মাআল্লাহ মজবুত করার একটি মাধ্যম

দ্বিতীয়ত আল্লাহর কাছে বেশি বেশি চাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। যখন যে প্রয়োজন দেখা দেবে, ছোট হোক কিংবা বড়, সাথে সাথে আল্লাহর দিকে রুজু করুন, আল্লাহমুখী হোন। আল্লাহর কাছে নিজের হাজত পেশ করুন- হে আল্লাহ, আমার এ সমস্যা দেখা দিয়েছে, সামনে আমার এই কাজ, আপনি আসানীর সাথে সমাধা করে দিন। বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে বের হয়েছেন। দুআ করুন- হে আল্লাহ, প্রয়োজনে বাইরে বের হয়েছি। আপনি ভালো সওয়ারির ব্যবস্থা করে দিন। সওয়ারিতে বসে- হে আল্লাহ, সহি-সালামতে আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিন। গন্তব্যে পৌঁছে- হে আল্লাহ যে কাজে আমি এখানে এসেছি সে কাজ সুন্দরমত সমাধা করে দিন।

এভাবে প্রতিটি কাজে আল্লাহমুখী হয়ে দুআর মাধ্যমে হাজত পুরা করুন।

রান্না করার সময়- হে আল্লাহ, আমি এখন রান্না করছি, তুমি আসান কর। বরকত দাও। এতে স্বাদ দান কর। সবার জন্য এ খাবারকে তুমি উপকারী বানাও।

মোটকথা, এমন একটি অভ্যাস গড়ে তুলুন, যাতে সর্বমুহূর্তে আপনি আল্লাহর কাছে কিছু না কিছু চাওয়ার মধ্যেই থাকেন। যবানে উচ্চারণ করেই যে চাইতে হবে, তা নয়; মনে মনে চাইতে থাকুন। যত বেশি পারেন চাইতেই থাকেন। আল্লাহর যাত অনেক বড়। তাঁর কাছে চাইলেই তিনি খুশি হন।

দুনিয়ার যে যত বড় দানবীরই হোক না কেন, তার কাছে যদি কেউ চাইতেই থাকে, তাহলে সে দুই বার, তিন বার, সর্বোচ্চ দশ বার দিবে। এরপর বলবে, আরে ভাই! তুমি দেখি আমাকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়বে। যাও এখান থেকে। এভাবে বকাঝকা করে তাড়িয়ে দিবে।

কিন্তু আল্লাহ তাআলার পাক যাত এত দয়ালু ও মেহেরবান যে, তুমি যতই চাইবে, তিনি ততই খুশি হন। শুধু তাই নয়, আল্লাহ বান্দাকে এত মহব্বত করেন যে, কেউ যদি তাঁর কাছে না চায়, তিনি তার প্রতি রুষ্ট হন।

এজন্য বোনেরা আমার! আমরা আল্লাহর কাছে বেশি বেশি চাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলি। চলতে-ফিরতে, উঠতে-বসতে শুধু আল্লাহর কাছে চাইতেই থাকব। যখন যে হাজত দেখা দিবে, ছোট কি বড়, আল্লাহর কাছে পেশ করব। আল্লাহর কাছে যত বেশি চাওয়া হবে নৈকট্য তত বাড়তে থাকবে। সম্পর্ক তত ঘনিষ্ঠ হতে থাকবে এবং তৈরি সম্পর্ক আরো মজবুত হতে থাকবে।

মাসনূন দুআর এহতেমামের ফায়দা

আমরা যাতে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি চাইতে থাকি, এজন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে অনেক দুআ শিখিয়েছেন। এজন্যই ঘরে প্রবেশের দুআ, বের হবার দুআ, হাম্মামে প্রবেশের দুআ, বের হবার দুআ, আয়না দেখার দুআ, মসজিদে গমন-নির্গমন ইত্যাদির দুআ তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। প্রতিদিনের এ মাসনূন দুআগুলো নিজেরাও শিখুন, বাচ্চাদেরও শেখান। নিজেরাও আমল করুন, বাচ্চাদেরও আমলে আনার ফিকির করুন।

বুযুর্গানে দ্বীনের অভিজ্ঞতা…

এই দুই তিনটি আমলের মাধ্যমে অর্থাৎ বেশি বেশি শুকরিয়া আদায়, বেশি বেশি দুআ এবং মাসনূন দুআর এহতেমাম- এই তিন আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য  লাভ হতে থাকে। আমি নিজের থেকে বলছি না, বুযুর্গানে দ্বীন বলেছেন, এ আমলগুলো যে যত বেশি করবে, আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক তত মজবুত হতে থাকবে। আর আল্লাহ তাআলার সাথে এরকম মজবুত সম্পর্ক হওয়ার মাঝেই আসল কামিয়াবী ও প্রকৃত সফলতা।

আল্লাহ তাআলা  আমাকে ও আপনাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين

সংগৃহীত.

Lorem Ipsum

Designed by Mohd Nassir Uddin