জীবন রহস্য ও দেহতত্ত্ব সংক্ষিপ্ত আলােচনা
হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আযহারুল ইসলাম সিদ্দিকী (রহ.) কর্তৃক লিখিত
গ্রন্থসমূহের পরিচিতি ও পর্যালোচনাঃ
যুগে যুগে যুগশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক দিকপালগণ তাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে যুগ থেকে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মীয় গাড়োমী বিদুরিত করেছেন। তার ব্যতিক্রম ঘটেনি অধ্যাপক হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আযহারুল ইসলাম সিদ্দিকী সাহেবের আল কুরআনুল কারীম ও সুন্নাহর আলোকে গবেষণামূলক, আধ্যাত্মিক ও বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখনীর ক্ষেত্রেও। মাওলানা সাহেবের লেখনীর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি আল-কুরআনুল কারীম ও সুন্নাহর বিধানকে বিজ্ঞানের উৎকর্ষের এ যুগে বিজ্ঞানের নির্যাস দিয়ে সুরভী ছড়িয়েছেন। যা সকল ধর্মের মানুষের নিকট সাদরে গৃহীত হয়েছে। আমরা এ অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
মাওলানা মুহাম্মাদ আযহারুল ইসলাম সিদ্দিকী রহ. সাহেব তাঁর জীবদ্দশায় নিম্নলিখিত আটখানা কিতাব রচনা করেন; যা তাঁর সুযোগ্য সাহেবজাদা ও প্রধান খলিফা হযরত মাওলানা মুফতি ড. মুহাম্মাদ মনজুরুল ইসলাম সিদ্দিকী সাহেব কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
১. বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পর্দা
২. তারানায়ে জান্নাত
৩. মহাস্বপ্ন।
৪. জীবন রহস্য ও দেহতত্ত্ব।
৫. মা’রেফতের ভেদতত্ত্ব
৬. ধূম পিপাসা সর্বনাশা
৭. মহা ভাবনা
৮. পীর ধরার অকাট্য দলিল
নিম্নে গ্রন্থ সমূহের বিস্তারিত পরিচিতি ও পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হলে
৪. জীবন রহস্য ও দেহতত্ত্ব
সংক্ষিপ্ত আলােচনা
আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর পর্বে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা সাহেব চিকিৎসাবিজ্ঞান নিংড়ানাে নির্যাস হিসেবে সূধী পাঠক মহলকে উপহার দিয়েছেন ‘জীবনরহস্য ও দেহতত্ত্ব’ নামক কিতাবটি।
এ কিতাবটি গবেষণায় আমরা মাওলানা সাহেবকে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল। তারকা হিসেবে অনুধাবন করেছি। বিজ্ঞানের অতি জটিল, নিরস, গাণিতিক বিষয়গুলােকে তিনি সাহিত্যের সুরভিতে সুধী পাঠক মহলের হৃদয়ে দোলা দিয়ে আল-কুরআনুল কারীমের নূর অবলােকন করিয়েছেন। যেমন মাওলানা সাহেব হৃৎপিণ্ডের পরিচয় ও কার্যকারিতা সম্পর্কে কিতাবটির শুরুতেই বলেন-“এ মুহূর্তে আপনি কেমন করে বসে আছেন, কেমন করে এই বইখানি পড়ছেন, কথা বলছেন, তা নির্ভর করে একটা আশ্চর্য যন্ত্রের উপর। সেটা স্পন্দিত না হলে, চোখের পলকে আপনি চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যাবেন। এই অবাক করা দুরূহ যন্ত্রটির নাম হচ্ছে হৃৎপিণ্ড।
Law of Newton এর মাধ্যমে মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও অস্তিত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে মাওলানা সাহেব বলেন, বিশ্ববিশ্রুত মহাজ্ঞানী বিজ্ঞানী নিউটন আইন প্রকাশ করলেন, সে আইন সারা বিশ্ব চোখ বন্ধ করে মেনে নিল। তিনি বললেন, জড় পদার্থে গতি সৃষ্টি না করে দিলে সে গতি সম্পন্ন হয় না এবং যতক্ষণ গতি সৃষ্টি করানাে থাকে ততক্ষণই এ জড় পদার্থ গতি সম্পন্ন থাকে। এ হচ্ছে। নিউটনের দেয়া আইন (Law of Newton)। হৃৎপিণ্ড একটা মাংস খণ্ড অর্থাৎ জড় পদার্থ । হৃৎপিণ্ডটা সৃষ্টি হবার পর নিচুপ হয়ে পড়েছিল গতিহীনভাবে। এতে কোন স্পন্দন ছিল না, কোন সংকোচন বা সম্প্রসারণ ছিল না । ডান বা বাম অলিন্দ এবং নিলয়গুলাে নিস্ক্রিয় অবস্থায় চুপ করে বসেছিল । হঠাৎ এক সময় এরা নড়ে উঠল, স্পন্দিত হতে লাগল এবং হৃদক্রিয়া শুরু হয়ে গেল । জড় পদার্থকে চালিয়ে না দিলে চলে না, গতি সৃষ্টি করে না দিলে গতি সম্পন্ন হয় না। বিজ্ঞানীর এ আইনে বিশ্বাসী যুক্তিবাদীরা, নাস্তিকরাও এ আইন মেনে নেয়। এই হৃৎপিণ্ডটি মানুষের জীবনকে প্রতিনিয়ত জীবন্ত অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখছে। সর্বাঙ্গ এমনকি তার যুক্তি করার ক্ষমতাও যে যুগিয়ে দিচ্ছে- এই হৃৎপিণ্ডটা প্রথম অবস্থায় অত্যন্ত নিস্ক্রিয় ছিল, ছিল গতিহীন, স্পন্দহীন, স্থবির। এটাকে প্রথম একটা ধাক্কা দিয়ে কে এতে গতি সৃষ্টি করে দিল ? বিজ্ঞানীরা বলেন, এটা আমরা জানিনা, এটা আমাদের বােধগম্য হয় না। হৃৎপিণ্ড কেন যে এমন করে নড়াচড়া করে, এর কারণ কেউ আজও খুজে বের করতে পারেনি। হৃৎপিণ্ডের এই স্পন্দনের একটা কারণ খুঁজে পেতে গিয়ে আরও হতবাক হয়ে তারা মহাস্রষ্টাকে স্বীকার করে নিয়েছে। তারা অনুসন্ধান করতে দিয়ে দেখেছে। ভ্যাগাস (Vagus) নার্ভ নামে একটা নালী মাথার নিম্নভাগ থেকে নেমে মধ্যচ্ছদা পর্যন্ত এসে মিশেছে। এটা হৃৎপিণ্ডে গিয়ে মিশেছে। ভ্যাগাস কথার মানে ভবঘুরে (Vagabond)। তড়িতের মত প্রবাহ এর ভিতর দিয়ে এসে হৃৎপিণ্ডে অনবরত প্রেরণা (Impulse) দেয়, সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিণ্ড সক্রিয় হয়ে উঠে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা শত চেষ্টা করেও আবিষ্কার করতে পারেনি এই প্রেরণা কোথা থেকে আসে এবং মস্তিষ্কের কোথায় এই প্রেরণা সৃষ্টিকারী মেশিন (Generating machine) । বিজ্ঞান বলে, প্রতিটি শক্তি (Energy) সৃষ্টির এক সৃষ্টিকারী মেশিন (Generating machine) আছে, যা থেকে শক্তির উৎস আসে। যেমন কাপ্তাই এর সৃষ্টিকারী মেশিন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়ে আসে, ডায়নামা থেকে শক্তি আসে । বিজ্ঞানীরা মাথা নত করে বলেছেন, ভ্যাগ্যাস নার্ভের প্রেরণার উৎস। শক্তি কোথায় তা নিশ্চয়ই অজানা এক শক্তির হাতে এবং এই শক্তিই হচ্ছেন।
আল্লাহ রাব্বল আলামিন। এমনিভাবে দেহতত্ত্ববিদগণ মানবদেহ জরীপ করতে গিয়ে অসংখ্য স্থানে মহাস্রষ্টা
আল্লাহকে মেনে নিয়েছেন। যিনি হৃৎপিণ্ডে স্পন্দন দিয়েছেন, যিনি প্রথম ধাক্কা দিয়ে হৃৎপিণ্ডতে স্টার্ট করিয়ে দিয়েছেন এবং যিনি ভ্যাগাস নার্ভে জীবন প্রবাহের প্রেরণা (Impulse) ইনজেক্ট করে দিচ্ছেন, তিনি সমগ্র সৃষ্টিকে জানিয়ে দিয়েছেন, “আল্লাহু নুরুস্সামাওয়াতে ওয়াল আরদ’ অর্থাৎ আসমান জমিনে যা কিছু প্রেরণা পায়, শক্তি পায়, হৃৎপিণ্ড তার চলশক্তি পায়, ভাগ্যাস নার্ভ প্রবাহ পায়, জীবকোষ তার শক্তি পায়। এসবের জেনারেটর হচ্ছি আমি, আমি মহা আলাে, মহাতেজময় শক্তি। আমার মহাশক্তির মেশিন থেকে সবাই শক্তি (Energy) পায়। আমার আলাে বিদ্যুতের প্রবাহের মত মস্তিষ্কে খেলে যায় অনবরত, তা থেকে ভ্যাগাস নার্ভ প্রবাহ পায়। সেই তড়িৎ প্রবাহ প্রতিনিয়ত হৃৎপিণ্ডকে উজ্জীবিত করে এবং তার স্পন্দন শক্তি যােগায়”। আল্লাহ অস্তিত্ব সম্পর্কে মাওলানা সাহেব কাব্যিক ভাষায় বলেন,
“নিশ্চয় আছেন একজন।
যে অর্থে আমরা বুঝি,
যে অর্থে আমরা খুঁজি
হয়ত তিনি নন তেমন
নিশ্চয় আছেন একজন।
সারকথা
মাওলানা সাহেব ‘জীবন রহস্য ও দেহতত্ত্ব’ নামক কিতাবের মাধ্যমে জীব বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ও দর্শনের যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন মহান আল্লাহপাক অতি দয়া করে মানব দেহের ভিতরের নানা জটিল কার্য কিভাবে
অনবরত সমাধান করছেন এবং দেহটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। মেডিক্যাল সাইন্সের নির্যাস বের করে আল-কুরআনের আলােকে এ কিতাবটি লিখেছেন। মানব দেহের কোথায় আল্লাহপাক থাকেন তার সঠিক প্রমাণ করা হয়েছে। অনেক নাস্তিক এ কিতাব পড়ে আল্লাহ পাকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণে মানবদেহের বিভিন্ন জটিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্রম সাহিত্য রসে ব্যাখ্যার প্রয়াস পেয়েছেন।
নামকরণের সার্থকতা
কিতাবটিতে মাওলানা সাহেব জীবনের মূল চালিকাশক্তি কিভাবে দেহটাকে বাঁচিয়ে রাখে, দেহের জটিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সমূহের কার্যক্রম, শক্তিপ্রাপ্তি, গতিপ্রাপ্তি, পরিকল্পনা, সিদ্ধান্তগ্রহণ, পরিচালনা ইত্যাদি অতিব রহস্যময় বিষয়াদি আলােচনা, তত্ত্ব উদঘাটন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমন্বয়ে মহান আল্লাহ রাবুল আলামিনের ক্ষমতা, পরিচয় ও অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। তাই নিঃসন্দেহে গ্রন্থটির নামকরণ জীবন রহস্য ও দেহতত্ত্ব যথার্থ এবং সার্থক হয়েছে বলে আমরা মনে করি।
প্রচ্ছদ পরিচিতি
কিতাবের নামটি অধ্যাপক সিদ্দিকী সাহেব (রহ.)-এর বড় সাহেবজাদা ও প্রধান খলিফা ড. মুহাম্মাদ মনজুরুল ইসলাম সিদ্দিকী সাহেবের একমাত্র সহেবজাদা এবং প্রধান খলিফা ও মাওলানা সাহেবের স্নেহধন্য নাতী মুহাম্মাদ মিক্বদাদ সিদ্দিকী সাহেবের স্ব-হস্তে অঙ্কিত নকশা। প্রচ্ছদ পরিকল্পনাটিও করেন তিনি। পরিকল্পনাটিতে তিনি ভাগ্যাস নার্ভ ও মটর নার্ভের গতিশক্তির পাশে মানব দেহকোষের কার্যক্রম ফুটিয়ে তুলেছেন। ঠিক মাঝখানে তিনি ফুসফুস, পাকস্থলি, ডিওডেনাম, ভিলাই গ্রন্থে আলােচিত ইত্যাদি অঙ্গপত্যঙ্গ সংযুক্ত করেছেন। ডান পাশে ব্যবচ্ছেদকৃত হৃৎপিণ্ডের অলিন্দ নিলয়কে চিহ্নত করেছেন। চূড়ান্ত নকশা অংকনের পূর্বে কিতাবটির প্রকাশক ড. মুহাম্মাদ মনজুরুল ইসলাম সিদ্দিকী সাহেব হৃৎপিণ্ডের লেক্ট ভেনট্রিক্যাল এ আরবীতে মহান আল্লাহ নাম আলিফ লাম লাম হা’ সংযােজন করেছেন। প্রকৌশলী মুহাম্মাদ রিয়াজুল হক কম্পিউটার গ্রাফিক্সে প্রচ্ছদটি নিখুঁতভাবে অংকন করেন।
বিস্তারিত জানতে ‘‘ জীবন দর্শন ও তাসাউফ চর্চা ‘’ কিতাবটি পড়ার অনুরোধ রইলো। রচনা ও সংকলন করেছেন- গবেষক মো: সেলিম-উল ইসলাম সিদ্দিকী সাহেব । যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম.ফিল. ডিগ্রী লাভ করেন ।
Lorem Ipsum